নতুন চাকরি পেয়ে কলকাতা এসেছি। সম্পূর্ণ অস্থায়ী চাকরি। যে-কোনাে সময়ে,
বিনা-কারণে ও বিনা নােটিশে বরখাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। নিয়ােগপত্রে এসব শর্ত
দেখেও ঘাবড়াইনি একটুও। বন-বিভাগে চাকরি করতাম ষাট টাকায় এখানে পাব একশাে
তিরিশ টাকা। দ্বিগুণেরও বেশি। এমন সুবর্ণ সুযোেগ কোনাে নির্বোধ পায়ে ঠেলে
দেয় বলে আমার মনে হয় না। আর যাই হােক, আমি দুপায়ে হাঁটি। জঙ্গলে যারা
চার পায়ে হাঁটে, তাদের পরিবেশে থেকে আমার বুদ্ধিটা লােপ পেয়ে যায়নি।
সত্তর টাকা বেশি পাব- এ কি যেমন- তেমন ব্যাপার। বিয়ে করােছ অল্পদিন। এখন
দ্বিগুণ টাকারই দরকার। তাছাড়া জঙ্গল ছেড়ে এসেছি শহরে, হিংস্ৰালয় ছেড়ে
লােকালয়ে, আঁধার ছেড়ে আলােকে। এরকম সভ্যসমাজে আসাটাও একটা মস্ত লাভ ।।
চাকরিতে যােগ দিয়েছি গতকাল। আজ দ্বিতীয় দিন, বৃহস্পতিবার। নটা না বাজতেই
খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। মেসের খাওয়া। কী খেলাম বলব না, বলতে লজ্জা করে।
তাছাড়া খাওয়াটা গৌণকর্ম, নেহায়েতই রান্নাঘরের ব্যাপার। যা মুখ্য তা
হচ্ছে আমাদের পােশাক। সাজ-পােশাকই আমাদের সভ্যতার মাপকাঠি কোনােরকমে শাকভাত
খেয়ে বেঁচে থাকলেও এ-দেহকে দুরস্ত খােলসে ঢেকে ভদ্রলােক সাজতেই হবে।
তাছাড়া উপায় নেই ভদ্রসমাজে বের হওয়ার। আমাদের মতাে খুদে অফিসারদের
ব্যাপার আরাে জটিল। কোট-প্যান্ট পরে, টাই বেঁধে দুরস্ত হওয়া চাই, নয়তাে
ওপরওয়ালা সায়েবদের সুনজর হবে না কোনােদিন। তাদের কথা : ঘােড়ায় চড়ে না
হােক, গাধায় চড়েও কেন আমরা তাদের অনুসরণ করব না? অফিসে তাই অনুকরণ ও
অনুসরণের প্রতিযােগিতা বেশ উপভােগের হয়ে দাঁড়ায়।
মেসের এক সদস্যের সাহায্য নিয়ে গলগ্রন্থিটা কোনােরকমে বেঁধে কোটটা গায়ে
চড়িয়ে দিই। আয়নায় মুখ দেখে ভালাে লাগে না। দাড়িগুলাের কালে মাথা দেখা
যাচ্ছে। অথচ গতকালই দাড়ি কামিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি সেফটি রেজার বের করে ঐ
অবস্থায়ই কয়েক পোঁচ টেনে নিই। কিন্তু শার্টের কলারটায় সাবানের ফেনা লেগে
যায়। তােয়ালে দিয়ে সেটা মুছে চুলে চিরুনি চালাই। আর-একবার। তারপর
জুতােজোড়া পায়ে ঢুকিয়ে আর একদফা আয়নায় মুখ দেখে বেরিয়ে পড়ি।।
নটা বাজে। পথ সংক্ষেপ করতে গিয়ে একটা ছােট্ট গলিতে ঢুকি। গলি নয় ঠিক। দুই
দেয়ালের মাঝখান দিয়ে সরুপথ । গা বাঁচিয়ে একজন যেতে পারে কোনােমতে।
মাঝপথে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে হয় আমাকে। একজন বুড়াে
ভদ্রলােক আসছিলেন ওদিক থেকে। দেহের আয়তন তার নিতান্ত ছােট নয়। তাই
কোলাকুলিটা হয়ে যায় ভালােভাবেই। তারপর একজন, আরাে এক, আরাে একজন।
কোলাকুলি সেরে বেরিয়ে যান তারা। কোলাকুলিটা যদিও সকলের সাথে সমান জমে না,
তবুও মনে হয় মানুষে মানুষে হানাহানির এ সময়টায় অজানা-অচেনায় এরকম
কোলাকুলি বড় দুর্লভ।
আর মাত্র কয়েক কদম পার হলেই বড় রাস্তা। দেয়াল ছেড়ে সবে সােজা হয়ে
দাঁড়িয়েছি, দেখি এক ভদ্রমহিলা গলিটায় ঢুকে পড়েছেন। আমার সামান্য কয়েক
কদমের পথটুকু পার হবার সুযােগ না দিয়ে এগিয়েই আসছেন তিনি। এবার আর উপায়
নেই। তাড়াতাড়ি পিছু হেঁটে শেষটায় উপায় করতে হয় আমাকেই।
দেয়ালে ঠেস্ দেওয়ায় শ্যাওলা লেগেছিল কোটে। রুমাল বের করে ঝেড়ে আমার পথ
দেখি আমি। এবার আর সােজাপথে নয়। সােজাপথটাই দেখছি কঠিন বেশি। বেনেপুকুর
লেন ঘুরে লােয়ার সার্কুলার রােড পার হয়ে ইলিয়ট রােডের মােড়ে এসে
দাঁড়াই।
ধর্মঘটের জন্যে ট্রাম বন্ধ। আমাকে যেতে হবে ৮ নম্বর বাসে। এক এক করে
কয়েকটা বাস চলে যায়। কতবার হাতল ধরতে গিয়ে পিছিয়ে যাই। সাহসে কুলােয়
না। লােকসব বাদুড়ঝােলা হয়ে যাচ্ছে। নিরাশ হবার পাত্র আমি নই। দাঁড়িয়ে
থাকি, দেখি অন্তত একটা পা রাখবার জায়গাও যদি মিলে যায়।।
একটা বাস এসে থামে। পা রাখবার জায়গা নেই। তবুও সব লােক ছুটোছুটি করছে, কে
কার আগে উঠবে। চাকরি ঠিক রাখার কী প্রাণান্ত চেষ্টা। একটা লােক নেমে যায়
ড্রাইভারের কুঠরি থেকে। মহাসুযােগ পাশের কয়েকজনকে টেক্কা মেরে চট করে উঠে
পড়ি আমি। চাকরি গেলে আমার চলবে না। হঠাৎ আমার বুকে ধাক্কা মেরে একজন
চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মানুষ, না জানােয়ার!
লােকটা কি গণক নাকি! গণকের মতাে ঠিকই তাে বলেছে সে! আমি জঙ্গলেই তাে ছিলাম
অ্যাদ্দিন। লােকটাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু সাহস হয় না।
ঘাড়টা নুইয়ে গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মেশামেশিটা
আগের কোলাকুলির মতাে প্রীতিকর হয় না। আমি শেষে ঢুকে অনেকের অসুবিধে করেছি।
ঠেলা-ধাক্কাটা তাই আমার দিকেই আসছে বেশি করে । পাঁজরের হাড়গুলাে চাপ খেতে
খেতে ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে। আর দেরি নয়। পরের স্টপে থামতেই আমি নেমে যাই।
এতক্ষণ দম বন্ধ হয়েছিল যেন। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসকে সজীব
করে নিই খােলা বাতাসে। স্যুটটার দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। ভেতরের ঘামে আর
ওপরের ঘষায় ইস্ত্রি ভেঙে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এবার পাদুটোকে সম্বল করেই
ছুটব ঠিক করলাম।
কলকাতা এসেছিলাম অনেকদিন আগে একবার। পথ-ঘাট ভালাে মনে নেই। পথ চেয়ে পথ
চলি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চেয়ে দেখতে হয় পথচারীদের পােশাকের দিকে। এই
পােশাক ছাড়া কার কী ধর্ম জানবার উপায় নেই। কারণ ধর্মের কথা গায়ে কিছু
লেখা থাকে না। সব ধর্মাপরাধীদের চেহারাই মানুষের চেহারা। আমার চেহারা দেখে
কিন্তু কারাে বুঝবার যাে নেই, আমার ধর্ম কী। ৪ কারণ আমার মানুষের শরীরটাকে
অন্তঃধার্মিকপােশাকে ঢেকে নিয়েছি। তাই বলে কি আমি নিরাপদ?
আন্তঃধার্মিক পােশাকে মানুষের চেহারা হলেও যে-কোনাে দিকের চাকু খাওয়ার ভয়
আছে আমার। মুসলমান মােটেই না। আমার বিপদ বরং বেশি। আমাকে হিন্দু ঠাওরালে,
আর হিন্দু মুসলমান ঠাওরালেই হলাে!
ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে। মন ইতিমধ্যে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। একশাে তিরিশ
টাকার চাকরিটার ভার ছেড়ে দিই পাদুটোর ওপর। শুধু তাই নয়, মনের বিরুদ্ধে
সমস্ত দেহের ভারটাও।
এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় পা দিয়ে থমকে দাঁড়াই। কাছাকাছি একটা
প্রাণীও দেখছি না যে! বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সুমুখের একটা দোতলা বাড়ির
দিকে চোখ পড়তেই দেখি, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কয়েকজন কী যেন দেখছে
রাস্তার দিকে। ওপর থেকে নিচের দিকে চোখ নামাতেই চোখ ফিরে আসে,পায়ের তলা
থেকে মাটি সরে যায়। গায়ের রােম কাঁটা দিয়ে ওঠে। চিনতে ভুল হয় না। মানুষ
হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত মানুষ। রক্তের রাঙা স্রোত ড্রেনে গিয়ে
মিশেছে।
নিমেষে পেছন ঘুরে অন্য পথ ধরি। গাড়ির আওয়াজ পেয়েও তাকাই না ফিরে। কিন্তু কে যেন গর্জে ওঠে, “ঠায়নরা।
দুজন সার্জেন্ট রিভলবার হাতে এগিয়ে আসে। আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে
তারা। কিন্তু ফাসাতে পারে না। নিয়ােগপত্রটা পকেটেই ছিল।সেটা দেখিয়ে রেহাই
পেয়ে যাই।
এবার আরেকটা রাস্তা ধরে হাঁটি হাঁটি সুমুখে পেছনে চেয়ে। মারটা নাকি পেছন
থেকেই আসে। এক একজন লােক চলে যায় পাশ কেটে, মনে হয় এক-একটা ফঁাড়া কেটে
যায় আমার। আমার সতর্ক চোখদুটো আড়চোখে তাকায় সবার দিকে। কিন্তু তারাও যে
সতর্কষ্টি মেলে আমারই তাকায়। আমাকে আমার হাত দুটোকেই বােধহয় তাদের ভয়।
তাদের ভীত চাউনি দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আমিও আমার অনুগত হাত দুটো
ছাড়া আর কারাে হাতকে বিশ্বাস করতে পারি না।
কিছুদূর আগে ডানদিকে একটা পাশগলি। গলির মুখে তিনটে লােক। তাদের পােশাক দেখে
চমকে উঠি। তাদের ভাবগতিকও কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার বুকের
ভেতরটা টিপটিপ শুরু হয়েছে। আশেপাশে লােকজন নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি এক
অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান তরুণী উঁচু-গােড়ালি জুতাে পায়ে আসছে গটগট করে। আমার
মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আমি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যাই। গলির
মুখের লােকগুলােকে বােঝাতে চাই, আমি তরুণীটির জন্যেই অপেক্ষা করছি। তারই
সাথী আমি। কিন্তু তারা বুঝতে চাইলে হয়। আমার যেরকম গায়ের রঙ! অবশ্য এরকম
রঙের অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ানের অভাব নেই কলকাতা শহরে।।
আমার পােশাক দেখে লােকগুলাে না হয় আমাকে অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান ঠাওরাল।
কিন্তু তরুণীটিকে কী বােঝাব? আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী মনে করবে
সে?
আমি উবু হয়ে বাঁ-পায়ের জুতাে খুলি। জুতাের ভেতর কাঁকর ঢুকেছে এমনি ভান
করে জুতােটা উপুড় করে ঝেড়ে নিই কয়েকবার। তারপর আবার পায়ে ঢুকাই।
তরুণীটি আমার কাছে এসে গেছে।
জুতাের ফিতে বাঁধা শেষ করে এবার তার পাশাপাশি চলতে শুরু করি। এখন ঠিক মনে
হচ্ছে রাস্তা ও দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান দম্পতি। অন্যের
কী মনে হচ্ছে জানি না। আমার কিন্তু * ওরকমই মনে হচ্ছে। এক-পা-দুপা করে গলির
মুখ পার হয়ে যাই।
ফাঁড়া কেটে গেছে। আমার নীরব সঙ্গিনী একবার কটমট করে আমার দিকে তাকায়। তার
চোখের দিকে চেয়ে আমার মনটা মিইয়ে যায়। কিন্তু তবুও তার সঙ্গ ছাড়তে
ভরসা পাইনে।
পাশাপাশি হেঁটে আরাে কিছুদূর এগিয়ে যাই। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলে সে, ‘আমার পিছু নিয়েছ কেন?
না-না-। আমি থতমত খেয়ে যাই। না মানে!
বহুক্ষণ ধরে আমি লক্ষ করছি। পু
লিশ ডাকব?
না-না, মানে-ইয়ে, মানে গুণ্ডার ভয়ে’ ‘গুণ্ডার ভয়ে।
হ্যা, তাই- তাই আপনার সাথে সাথে এলাম।
‘অবাক করলে এক জোয়ান পুরুষ, তাকে রক্ষা করলে মেয়েমানুষ? আচ্ছা কাপুরুষ তাে! অবজ্ঞার হাসি তরুণীটর মুখে।
কিছুদূর গিয়ে মহিলা বা-দিকে এক গলিতে ঢুকে পড়ে। আমি মােড় নিই ডানদিকে।
পাশ থেকে একটা হাত এগিয়ে আসছে না আমার দিকে!
উহ্ মাগাে’ বলে লাফ দিয়ে সরে যাই কয়েক হাত।
ফিরে দেখি একজন জটাধারী ফকির হাসছে আমার অবস্থা দেখে। এগিয়ে এসে সে বলে, ভয় পেলি নাকি? দুদিন খেতে পাইনি। দুটো পয়সা দে।
রীতিমতাে ঘাম দিয়েছে আমাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরােয় না। তবু হাতে চাকু
না-থাকার জন্যে ফকিরটাকে ধন্যবাদ দিই মনে-মনে আর পকেট থেকে দুটো পয়সা বের
করে তার দিকে ছুঁড়ে মারি । চৌরঙ্গী এসে পড়েছি। একটা লােক হঠাৎ আমার পথ
আগলে দাঁড়ায়। বলে, ফটো তুলবেন? আসুন। এক টাকায় তিন কপি।
লােকটার কথার জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কিন্তু ভুল হয়ে গেল। মানুষের ভয়ে ভীত মানুষের ফটোটা তুলে রাখা উচিত ছিল আমার।।
হঠাৎ কার স্পর্শে শিউরে উঠি।
চেয়ে দেখি, আমাদের সুভাষ মুচকি হাসছে। সহপাঠী বন্ধুর আলিঙ্গনে বুকের
ভেতরটা যেন ভিজে ওঠে। কিন্তু ওর বুকটা শক্ত লাগল না! জামার ওপর হাত রাখি ।
তাই তাে!
সুভাষ হেসে বলে, হাত দিয়ে দেখছিস কী?
‘দেখছি, মানে-তাের বুকটা শক্ত লাগছে কেন রে?
‘শক্ত লাগছে হুহু হু। এ জিনিস দেখিস নি কখনাে। লােহার তারের গেঞ্জি। একেবারে নয়া আবিষ্কার।
নয়া আবিষ্কার।
‘হ্যা, এ বর্ম ভেদ করবে চাকু? উঁহু!
সুভাষের জামার ওপর হাত দিয়ে দিয়ে আঁচ করতে পারি, লােহার তার দিয়ে তৈরি
হাতাকাটা গেঞ্জি। মন্দ জিনিস নয়। সহসা আঘাত করে কিছু করতে পারবে না।
আমি হেসে বলি, “কিরে চাকু-টাকু লুকানাে নেই তাে?”
‘নেই তাে কী! নিশ্চয়ই আছে। এক্ষুনি তাের বুকে বসিয়ে দেব। তাের রক্ত দিয়ে ফেঁটা-তিলক কেটে কালীপুজো করব।'
‘এখানে কী করিস?
‘পড়ি আর্ট স্কুলে।
‘আর্ট স্কুলে! ঠিক আছে। শােন, তােকে একটা ছবি আঁকতে হবে। মানুষের ভয়ে
মানুষের চেহারা কেমন হয়, ফুটিয়ে তুলতে হবে সেছবিতে। পারবি তাে?”
‘তা দেখব চেষ্টা করে।
আরাে দু-এক কথা বলে বিদেয় হই তাড়াতাড়ি।
হেঁটে হেঁটে চৌরঙ্গী পর্যন্ত আসি। কিন্তু পা আর চলে না। চলবার কোনাে হেতু
নেই যে! ভােরে যা খেয়েছি, আর এ-পর্যন্ত এক পেয়ালা চা-ও না। কার্জন পার্কে
বসে পড়ি। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। ভিড় কমলে বাসেই যাব ।
সাড়ে ছ'টার সময় বাসে একটু জায়গা পাওয়া যায়। পঁ-প করতে করতে বাস ছুটছে।
এত ভিড়, বাইরের কিছুই দেখা যায় না। বুঝতে পারছি না, কোন রাস্তা ধরে চলছে
গাড়ি।
বুম্--
আবার বুম-- ভীষণ শব্দ।
কানে তালা লেগে গেছে। শুনতে পাই না কিছু। শেয়ালের ভয়ে খাঁচার মােরগের
মতাে করছি আমরা। তারপর কোন দিক দিয়ে কেমন করে বাসখানা চলে এল, অত খেয়াল
নেই। কয়েকজনের মুখে শুনলাম, বাসের পাদানির ওপর থেকে দুজনকে দুপেয়ে
শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে। আর অনেকের হাত-মুখ নাককান ছিড়ে গেছে বােমার
আঘাতে।।
ঘরের কাছে এসেও আর-একবার শিউরে উঠি। অক্ষত দেহে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে ফিরে এসেছি আমি।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শিথিল শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় ঢেলে দিই। মানুষের
মাঝে একদিন চলেই মুষড়ে পড়েছি আমি। আমার সমস্ত রাগ ঘৃণা আজ মানুষের ওপর।
চোখ বুজে ভাবছি পদত্যাগপত্রটা প্রত্যাহার করার এখনাে হয়তাে সময় আছে। আমার
জন্যে বন বিভাগের চাকরিটা ভালাে। মানুষ তার মনুষ্যত্ব নিয়ে শহরে থাক। আমি
বনে গিয়ে আবার বনমানুষ হব।
শব্দার্থ ও টীকা : হিস্ৰালয়-
হিংস্র প্রাণীর বাসস্থান। গলগ্রন্থি- গলার বন্ধনী। ছাতলা- শ্যাওলা,
দেয়ালে জমা পুরানাে ময়লা। অ্যাদ্দিন- এতদিন শব্দের কথ্যরূপ। ঠ্যায়রাে-
দাঁড়াও। ঠাওরালাে মনে করল। চেীরী- চার রাস্তার মিলনস্থল। কলকাতার একটি
স্থানের নাম ।
পাঠ-পরিচিতি : ভারত
বিভাগের আগে ১৯৪৬ সালে এ অঞ্চলে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। এ
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে বনমানুষ গল্পটি লিখিত। এ গল্পের লেখক বন
বিভাগে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। তিনি দ্বিগুণ বেতনে কলকাতায় চাকরি করতে
আসেন। কলকাতায় এসে প্রথমে তাঁর নিজেকে সভ্য মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু
তিনি তখন সাম্প্রদায়িক হানাহানির মুখােমুখি হতে e থাকেন। তিনি দেখেন এ
শহরের মানুষেরা ধর্মের নামে পরস্পরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। বনের ও
পশু-পাখিরাও এ রকম পরস্পরকে হত্যা করে না। তখন লেখক আবার বন বিভাগের
চাকরিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লেখকের কাছে এ শহরের সভ্য মানুষের
চেয়ে বনে বসবাসকারী অশিক্ষিত মূর্খ মানুষকে অধিক গ্রহণযােগ্য মনে হয়। এ
গল্পের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে লেখকের তীব্র ঘৃণা
প্রকাশ পেয়েছে।
লেখক-পরিচিতি :
আবু ইসহাক ১৯২৬ সালের ১লা নভেম্বর শরীয়তপুর জেলার শিরঙ্গল গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাস করার পরই
সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীণ হন। ১৯৮৩ সালে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। সাহিত্য
সাধনায় তিনি স্বীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি গ্রামবাংলার চিত্র এবং
সেখানকার সমস্যা অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। এদিক থেকে তাঁর
‘সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসটিকে বাস্তব জীবনের সার্থক চিত্রণের উজ্জ্বল
নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসটি আমাদের
সাহিত্যে একটি উল্লেখযােগ্য সংযােজন। উপন্যাস-সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি
১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলাে :
সূর্যদীঘল বাড়ি, হারেম, মহাপতঙ্গ, পদ্মার পলিদ্বীপ ইত্যাদি। আৰু ইসহাক
২০০৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৃজনশীল প্রশ্ন : গ্রীষ্মের
ছুটিতে মনির তার মামার বাড়ি কলকাতায় বেড়াতে গেল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে
না যেতেই মামাবাড়ি তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। মামা, মামি, মামাতাে
ভাই-বােনরা তার সাথে ভালােভাবে কথা বলত না। মামি তার দ্বারা অনেক কাজ
করিয়ে নেওয়া শুরু করল। মামাবাড়ির বদ্ধ দেয়াল তার কাছে জেলখানা মনে
হলাে। তার বারবার মনে পড়তে লাগল ফেলে আসা গ্রামের বিরাট সবুজ মাঠ, নদী,
বন্ধু-বান্ধব, আপনজনের চেহারা।
ক. ধর্মঘটের জন্য কী বন্ধ হয়েছিল?
খ. কথক বনে গিয়ে আবার বনমানুষ হতে চান কেন?
গ. উদ্দীপকের যে ভাবটি ‘বনমানুষ’ গল্পে পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকের মনির যেন ‘বনমানুষ’ গল্পের কথকেরই প্রতিনিধিত্ব করছে- উক্তিটি যুক্তিসহ বুঝিয়ে লেখ।
0 Comments